Tuesday, January 13, 2015

প্রসবজনিত ফিস্টুলা

প্রসবজনিত ফিস্টুলা একটি মারাত্মক ও যন্ত্রণাদায়ক রোগ। এর কারণে রোগী একাধারে শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর চিকিৎসা না করালে জ্বালাপোড়া, ক্ষত বাড়তেই থাকে। ফলে একসময় কিডনি রোগ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে কিডনি ফেইলিউরে মৃত্যুও ঘটতে পারে। অনবরত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রস্রাব-পায়খানা পড়তে থাকা খুবই কষ্টকর, তাই বেশিরভাগ মহিলা এটি কমাতে খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেয়। তাই শরীরে পানির অভাবে দেখা দেয় ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা। বাধাপ্রাপ্ত প্রসবের জন্য মূত্রনালি এবং মাসিকের রাস্তায় এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়ে দুটি রাস্তা এক হয়ে যায় এবং অনবরত ওই রাস্তা দিয়ে প্রস্রাব ঝরতে থাকে। এ ধরনের দুর্বিষহ শারীরিক সমস্যাকে প্রসবজনিত ফিস্টুলা বলা হয়।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা

বাংলাদেশে প্রসবজনিত এই ফিস্টুলা রোগ সম্পর্কে সবাই না জানলেও এ রোগীর সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। গ্রামাঞ্চলে অদক্ষ দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসবের জটিলতার কারণে অসংখ্য মা আক্রান্ত হচ্ছেন যন্ত্রণাদায়ক এই ফিস্টুলা রোগে। আমাদের দেশের শতকরা ৪০ ভাগ অধিবাসী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এসব পরিবারের মেয়েদের ১৫ বছর বয়সের মধ্যেই বিয়ে দেয়া হয় এবং ১৮ বছর পার না হতেই এরা প্রথম সন্তান ধারণ করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২৩ মে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রসবজনিত ফিস্টুলা দিবস টি পালিত হয়েছে। ওই দিন সরকারি ছুটি থাকার কারণে বাংলাদেশে গত সোমবার দিবসটি পালিত হয়।
মহিলা যৌনাঙ্গ
এদের বেশিরভাগই প্রসব পূর্ববর্তী, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্য জটিলতাগুলো সম্পর্কে জানে না। আবার এর শতকার ৯০ ভাগের প্রসব হয়ে থাকে নিজেদের ঘরে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই যে, বাংলাদেশে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা আনুমানিক ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ। ইউএনএফপিএ-এর অর্থায়নে এনজেন্ডারহেলথ, বাংলাদেশ ২০০৩ সালে প্রসবজনিত ফিস্টুলা পরিস্থিতির একটি জরিপ পরিচালনা করে। যাতে দেখা যায়, প্রতি ৩ হাজার বিবাহিত মহিলার মধ্যে ৫ জন প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন। বাংলাদেশে ১৫-৩০ বছরের অশিক্ষিত, দরিদ্র, অজ্ঞ এবং অসচেতন মহিলারাই এই ফিস্টুলা রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ২০০২ সালে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ফিস্টুলা রোগী ভর্তি হয়, যার সংখ্যা ছিল ৬৩। সবচেয়ে কম ছিল রাজশাহী মেডিক্যাল হাসপাতালে—১৬ জন। জরিপে দেখা যায়, ঢাকা, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশালে ৬টি মেডিক্যাল হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বহির্বিভাগে আসেন ২৪০ জন প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগী। এর মধ্যে ১৯২ জন ভর্তি হন এবং অপারেশন করান ১২৩ জন রোগী। এনজেন্ডারহেলথ, বাংলাদেশের আরেকটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১০০০ বিবাহিত মহিলার মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা প্রায় ১.৬৯ জন।
প্রসব ফিস্টুলা
প্রসব ফিস্টুলা

প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগ : আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৮ শতকে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রথম ফিস্টুলা রোগ পাওয়া গেলেও উনিশ-বিশ শতকের মধ্যে এর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে শুধু গর্ভকালীন সতর্কতার কারণে। তারপরও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপমতে বিশ্বে আনুমানিক ২ মিলিয়নেরও বেশি মহিলা ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত এবং প্রতি বছর আনুমানিক ১ লাখেরও বেশি মহিলা নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর মাত্রা বেশি।

ফিস্টুলা কি?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ফিস্টুলা হচ্ছে দুইটি এপিথেলিয়াম প্রান্তের অঙ্গ বা ধমনী-শিরার মধ্যকার অস্বাভাবিক সংযোগপথ, যা সাধারণত যুক্ত থাকে না—এটি মূলত রোগের অবস্থা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আঘাতজনিত কিংবা অপারেশনের কারণে ফিস্টুলা হয়ে থাকে। গ্যাস্ট্রোইনটেসটিনাল, অ্যানাল, অবসটেট্রিক ইত্যাদি ধরনের ফিস্টুলা হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে অবসটেট্রিক বা প্রসবজনিত ফিস্টুলা।
প্রসবজনিত ফিস্টুলার চিকিৎসা মানেই সার্জারি বা অপারেশন। এটি একটি রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারি। জটিল সার্জারির ক্ষেত্রে এর চিকিৎসা সাফল্য শতকরা ৬০ ভাগ এবং সাধারণ সার্জারিতে তা শতকরা ৯০ ভাগ। এই অপারেশন মূলত তিনটি ধাপে করা হয়।
সাধারণত ডেলিভারির ৭-১৪ দিনের মধ্যে ফিস্টুলা দেখা যায়। আমাদের দেশে ফিস্টুলাজনিত রোগীর সংখ্যা কমপক্ষে হলেও ৭০ হাজার। ফিস্টুলার জন্য একজন মেয়েকে অনেক কষ্ট সইতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সবাই তাকে ত্যাগ করে।
প্রথমত, অপারেশনের আগে ফিস্টুলা, যোনিনালী, মলদ্বার ও প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন, ক্ষত, জ্বালাপোড়া সারাতে এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়া হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ফিস্টুলা সারাতে ইন্ট্রাভেনাস এ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়।
দ্বিতীয়ত, ফিস্টুলা ইনফেকশন ঠিক হয়ে গেলে অপারেশন করতে হবে। এতে প্রথমে ফিস্টুলাটুকু পর্যবেক্ষণ করে অপারেশনের মাধ্যমে বাদ দিয়ে পরে সেই স্থান জোড়া লাগিয়ে ঠিক করে দেয়া হয়।
প্রস্রাবের রাস্তা
প্রসবজনিত ফিস্টুলা
তৃতীয়ত, অপারেশনের পর কিছু মহিলার প্রস্রাব-পায়খানার জন্য ক্যাথেটার ব্যবহার করতে হয়। অপারেশনের কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত চিকিত্সকদের নির্ধারিত খাদ্যাভাস পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। শক্ত ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ থাকবে। নিয়মিত যৌনাঙ্গ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যাতে কোন জ্বালাপোড়া দেখা না দেয়।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা যেভাবে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব

১. দেরিতে বাচ্চা নেওয়া। কমপক্ষে ২০ বছর বয়সে বাচ্চা নেওয়া।
২. যাদের উচ্চতা ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি বা তার নিচে এবং যাদের প্রসবের রাস্তা চাপা থাকে তাদের অবশ্যই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ডেলিভারি করতে হবে।
একজন রোগী কাছাকাছি যে কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা পেতে পারেন ।মনে রাখবেন, ফিস্টুলা একটা মারাত্মক সমস্যা এবং প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।নিজে সচেতন হোন এবং অন্যকেও সচেতন করুন।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা চিকিৎসা না করানোর পরিণতি

মাতৃমৃত্যু ও মাতৃ অসুস্থতা—এ দুইটি বিষয়েই সরকারকে অধিকতর নজর দিতে হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে অর্থ বরাদ্দ ও জনমানুষের মধ্যে বৃদ্ধি করতে হবে ব্যাপক সচেতনতা। কারণ জনসচেতনা বৃদ্ধি শুধু এক-দুইটি বিজ্ঞাপন দিলেই শেষ হয়ে যায় না, এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সরকারের উপলব্ধি আনতে হবে মাতৃমৃত্যু ও প্রসব পরবর্তী মহিলাদের দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যাকেও। আর তাই এ খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থের যোগানও দিতে হবে। কেউ হয়তো বলতে পারেন, প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ শুরু হলে এর চিকিৎসা করালেই তো হয়। হ্যাঁ, চিকিৎসা করানো যেতে পারে। তবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে যেখানে কোন দক্ষ সেবক নেই, সেখানে কিভাবে চিকিৎসা হবে? চিকিৎসার জন্য চাই ব্লাড ট্রান্সফিউশন, স্যালাইন, হাসপাতালে এনে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, এ্যান্টিবায়োটিক শুরু করা। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষ সচেতন হলে এর সমাধান সম্ভব। এ বিষয়ে শুধু চিকিত্সকদের প্রশিক্ষণ দিলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মা সন্তান প্রসব করছেন। কাজেই কিউরেটিভ দিক বিবেচনা করলে এটা প্রায় অসম্ভব। তাই ব্যাপকভিত্তিক সচেতনতাই পারে এ ধরনের সমস্যা থেকে আমাদের রক্ষা করতে।
   

সূত্র:হেল্থ বাংলা ডট কম

Labels:

0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home